আমার ফেলে আসা দিনগুলি
-অঞ্জনা গোড়িয়া
আজ ৫ই সেপ্টেম্বর।
শিক্ষক দিবস।
কিন্তু জানো কি আজ আমার জন্মদিন?
কত কিছুই মনে পড়ছে আজ। এই দিনে বাবা, নতুন জামা আনতো আমার জন্য। মা, নিজে হাতে পায়েস রেঁধে খাইয়ে দিত। বাবা বলতো, দেখ মা, আজ তোর জন্মদিন। তোকে শিক্ষক হয়েই জন্মদিনটা স্বার্থক করতে হবে। কি জানি, সেদিন কি বলে ছিলাম। তবে দিদিমণি হওয়ার খুব সখ ছিল আমার।
খেলতে খেলতে দিদিমণি সাজতাম। আর মাটির পুতুলদের পড়াতাম। সে সব দিন আর নেই। এখন আমি দুই সন্তানের মা। স্বামী সোহাগী স্ত্রী আর সংসারে নিপুণা গৃহবধূ । আবার স্কুলের দিদিমণি ও বটে।
ডায়েরির পাতা ঘাটতে গিয়ে কত কথায় মনে পড়ছে।আজ আবার একটা জন্মদিন।
কেউ আর পায়েস রাঁধে না। নতুন শাড়ি আনে না। নিজের জন্মদিন, নিজেকেই মনে রাখতে হয়। আর মনে রাখে ফেসবুক বন্ধু। কত শুভেচ্ছা বার্তা আসে এই দিন। মনটা আনন্দে ভরে যায়।
বাবার স্নেহ ভরা মুখ, স্কুলের দুষ্টমির দিনগুলি তবু ভোলা কি যায় সহজে? ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়া। নিজের পায়ে দাঁড়াবো। অনেক অনেক বড়ো হবো। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো, পরিস্থিতি আর গ্রাম্য সংস্কৃতি। একাকী মেয়ে, শহরে পড়তে যাবে? পথে ঘাটে সবসময় বিপদের আশঙ্কা। অজপাড়া গাঁয়ের মেয়ে আমি। জ্যেঠু পরিস্কার বলে দিল, আর পড়াশোনা নয়। এবার মেয়ের বিয়ে দে ভাই।
আমার বাবা, খুব ভালো মানুষ। কোনো দিন কোনো কাজে আমাকে বাঁধা দেয় নি বাবা।
বাবার কাছে আবদার করলাম, আমি পড়বো, অনেক দূর। স্বনির্ভর হবো আমি। পড়তে দাও বাবা। বিয়ে করব না আমি।
বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, সাবধানে যেতে পারবি তো মা? শহরের কলেজে?
আমি বললাম পারব,বাবা। আমাকে পারতেই হবে।
কলেজ যাওয়া শুরু করলাম। সেই সকালে বেড়িয়ে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যেত। বাবা মায়ের চিন্তার অন্ত থাকত না। সমস্ত ভয় ভাবনাকে তুচ্ছ করে পড়াশোনায় মন দিলাম। পথে ঘাটে বিপদের হাতছানি। মনকে শক্ত করে সাহস মনে এগিয়ে চলি। দিব্যি চলছিল সব কিছু। সবে মাত্র প্রথম বছর বি.এ। বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লো। হসপিটালে ভর্তি করতে হলো। দিনের পর দিন লড়াই করে বাবার চিকিৎসার টাকা যোগাড় করলাম। শেষ রক্ষা হলো না। চলে গেল আদরের বাবা। মা,আমি ভাই ভীষণ একা। কোন দিন এমন পরিস্থিতি আসবে ভাবতে পারিনি। ডাল, আলু ভাত খেয়েই দিন কেটেছে একবেলা।
মায়ের তখনও পেনশন চালু হয় নি। আমি কিছু টিউশন ধরলাম। মা, সেলাইয়ের কাজ শুরু করল। কোনক্রমে দিন কাটলো। নিজের খরচে বি. এ. পাশ করলাম। এবার একটা চাকরি একটা কাজ একটা স্বাবলম্বী হবার উপায় চাই। এক্সচেঞ্জ অফিসে ছোটাছুটি দিনের পর দিন। যদি কিছু সুখবর আসে?
এলো না। অবিবাহিত বড়ো মেয়ে, বাড়িতে থাকলে, পাড়াগাঁয়ে ঢি ঢি পড়ে যায়। রোজ মাকে চারটি কথা শুনতে হতো। এত বড়ো মেয়ের এখনো বিয়ে দাও নি? রাস্তা ঘাটে একা একা টো টো করে ঘুরবে? কেমন মা গো তুমি?
শুরু হলো দেখাশোনা। রাজি ছিলাম না৷ শুধু মায়ের মুখের দিকে চেয়ে মেনে নিলাম।
আবার শুরু হলো পাত্র পক্ষের সামনে নাটকীয় মুহুর্ত।সং সেজে, সেজেগুজে হাজির হতে হয় পাত্রপক্ষের সামনে। মাথার চুল থেকে নখ পর্যন্ত ভালো করে নিরি
নিরীক্ষন করত। অসহ্য এক যন্ত্রণা। আমি একটা বাজারের পন্য সামগ্রী। দর কষাকষি তারপর বিক্রি।শেষে ভেবে নিলাম, যে বলবে বিয়ে করবে, তাকেই বিয়ে করে নেব। ভালোবাসা শিখিনি। ভালোবাসা কি জানি না। ভালোবাসার কথা বলে ছিল রাম,শ্যাম, মধু অনেকে। আমি পাত্তাই দিই নি। বড়লোক বাপের অহংকারী মেয়ে আমি। আত্ম- সম্মানে অটুট। যার তার সাথে প্রেম? আমকে ঠিক মানায় না।
আজ যখন বাবা নেই, সেই দম্ভ অহংকার মাটিতে মিশে গেল। আজ আর কেউ বলে না বিয়ে করব? আজ বড়ো একা। একটা কাজের খুব দরকার, এই সময়। একটা বেসরকারি স্কুলে সুযোগ হলো। সেখানেই যোগ দিলাম। একটু স্বস্তি পেলাম।
সব আশার প্রদীপ যখন নিভো নিভো। ঠিক যখন, কোনো এক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হলো। ঠিক তখনই আমার সব চেয়ে দামী সুখবরটা এসে হাজির। আমার চাকরির ইন্টারভিউ। বিয়ে বাতিল করে দিলাম।
হাতে স্বর্গ পেলাম৷। মাস্টারীটা পেয়ে গেছি বাবা। তুমি কি দেখতে পাচ্ছো? হাপুস নয়নে কেঁদে ফেললাম। ঠিক বিজয় দশমীর দিন নিয়োগ পত্র হাতে পেলাম। বাবা, তুমি কি দেখতে পাচ্ছো, তোমার মেয়ে আজ দিদিমনি। স্বনির্ভর হয়েছে। বাবা,তুমি আজ কত দূরে? তবু জানি আমার খুব কাছেই আছো সব সময়।
আমার স্মৃতির পাতায় স্মরণীয় এ দিন। আমার দিদিমণি হওয়ার সংবাদ। তারপর — আজ ১৭ বছর পার। পাকাপোক্ত সংসারী আর দিদিমণি। এখন আমি লেখিকা হওয়ার স্বপ্ন দেখি। এখানেও অনেক বাঁধা অনেক কাঁটা। সব কাঁটাকে উপড়ে ফেলে ফুল ফোটাবোই। বাবার আশীর্বাদ মাথায় থাকলে, এক দিন তাও সম্ভব হবে।
আমি পারব, আমার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে। তোমরা পাশে আছো কি?